ছেলে ক্লাস ফোরে পড়ে। ভেবেছিলাম ৬-৭ টা কোচিং সেন্টারে পড়িয়ে বুস্ট কিংবা হরলিক্স খাইয়ে ছেলেকে গোল্ডেন ফাইভ পাইয়ে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিবো। গোল্ডেন ফাইভ বলে নাকি কিছুই নেই। হুহ। বললেই হলো? অভিভাবক, শিক্ষার্থী , আর শিক্ষকরা তো গোল্ডেন ফাইভ গোল্ডেন ফাইভ বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলল। আমার আবার নিন্দুকের অভাব নেই। তাদের মনে যেন কোন সন্দেহ তৈরি না হয় সেজন্য মার্কশীটের স্ক্রীনশটের ছবি দিবো। এক্কেবারে পাক্কা সবুদ।
কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি।সরকার প্রাথমিকে পি ই সি পরীক্ষা তুলে দিয়েছে। বলেন সহ্য হয়?
অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাওয়া আমার অন্যতম বিনোদন। তাই কোন বাচ্চার সাথে কথা হলেই তাকে জিজ্ঞেস করি, বাবু তোমার নাম কী?, কোন স্কুলে পড়ো?, রোল নাম্বার কত?
এই রোল নাম্বার জিজ্ঞাসা করি ভয়ে ভয়ে আর মনে মনে দোয়া পড়তে থাকি, আল্লাহ এই বাচ্চার রোল নাম্বার যেন আমার বাচ্চার চাইতে বেশি হয়।
কেন দোয়া করব না বলেন? আমার বাচ্চার রোল নাম্বার যাতে ১ হয় তার জন্য কত পরিশ্রমই না করি। সারাদিন এই কোচিং সেই কোচিং, এই স্যার সেই স্যারের কাছে বাচ্চাকে নিয়ে ঘোরাঘু্রি করি।
ছোটবেলায় শিক্ষকরা শিখিয়েছেন,
'আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয় লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।'
এ শিক্ষা উল্টে গেছে। রাস্তায়, গলিতে গলিতে কোচিং সেন্টারের পোস্টার, ব্যানারে শিক্ষকরা নিজেরাই নিজেদের স্যার সম্বোধন করে নিজের ঢোল নিজেই পিটাচ্ছেন। যত প্রচার তত প্রসার।
আমি সেই কোচিং সেন্টারের পেছনে দৌড়াচ্ছি। নিজে জীবনে ফার্স্ট হতে পারিনি। নিজের অপূর্ণ বাসনা আমি তো বাচ্চার মধ্য দিয়েই বাস্তবায়ন করব। তাই না?
হয়ত ভাবছেন বাচ্চার উপর মানসিক চাপ বাড়বে। আরে রাখেন ভাই চাপ। যত চাপ তত লাভ। তত জিপিএ ৫, তত কম রোল নাম্বার।শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য তো বহুদূর। নিজের মানসিক স্বাস্থ্যরই খোজ রাখে কে?
আসল কথায় আসি।শিক্ষার্থীদের রোল নাম্বার ১-১০ এর মধ্যে থাকা নিয়ে শিক্ষার্থী - অভিভাবকদের যে আত্মসুখ, আত্মগরিমা সেই আত্মসুখ আর আত্মগরিমাকে ধুলিস্যাৎ করার জন্য এখন নাকি ইউনিক স্টুডেন্ট নাম্বার চালু হবে, আমি আবার আমার আত্মসুখ থেকে বঞ্চিত হবো। সহ্য করা যায়?
যারা মুসলিম তারা মৃত্যুর পর সবাই বেহেশতে যেতে চায়, কিন্তু 'মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে।'
ইউরোপ, আমেরিকা বা জাপানের মত আমি আমার শিক্ষা ব্যবস্থা চাই। ওসব দেশে বাংলাদেশের মত পরীক্ষা পদ্ধতি প্রাথমিক শিক্ষায় নেই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ধারাবাহিক মুল্যায়ন, লার্নিং বাই ডুইং, গ্রুপ ওয়ার্ক, গ্রুপ একটিভিটির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শেখে। এই পদ্ধতিই বিজ্ঞানভিত্তিক। অথচ আমি এ শিক্ষার নিন্দা করি প্রাথমিকে পরীক্ষা নাই বলে। বেহেশতে যেতে চাই কিন্তু মরতে চাই না। না মরলে যে বেহেশতে যাওয়া যায় না সেটা আমি মেনে নিতে পারিনা। কী আশ্চর্য স্ববিরোধিতা। নীরদ সি চৌধুরীতো আগেই বলেছেন " আত্মঘাতি বাংগালী"। আমরা প্রাথমিকে পরীক্ষা চাই আবার পশ্চিমাদের মত শিক্ষা ব্যবস্থাও চাই।
শিখন পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন শিক্ষক, শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের একটা বড় ঝাঁকি দিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সবচেয়ে বেশি ঝাঁকি খেয়েছে আমার মত অভিভাবকদের অহম, আর সামন্তীয় মানসিকতা। আমি মেনেই নিতে পারিনা আমার ছেলে রান্না করবে। পুরুষতান্ত্রিকতা আমার উপর সিন্দাবাদের দৈত্যের মত চেপে বসেছে। অথচ এই ছেলেই যখন বিদেশে গিয়ে হাত পুড়িয়ে রান্না করে তখন আমিই আবার আহা উহু করি ও করব।। কী আশ্চর্য স্ববিরোধিতা!
জগত এগোচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দেশ। উন্নত বিশ্বের সাথে আমাকেও পরিবর্তিত হতে হবে সে কথা আমি ভুলেই যাই।
রান্নার মত বেসিক শিক্ষা নারীরাই করবে - এধারনা থেকে মুক্তি না পেলে আমার যে মুক্তি নাই সেকথা আমরা ভুলে যাই।
কর্মমুখী, বেসিক স্কিল নির্ভর শিক্ষার বিকল্প নেই।
আমিই আমার বাচ্চাকে মানসিক ও শারিরিকভাবে পংগু করে তুলছি। নিজেদের নিবিড় পরিচর্যায় আমি আমার শিশুকে আত্মবিশ্বাসহীন করে গড়ে তুলছি আর দায় চাপাচ্ছি সরকার ও রাষ্ট্রের উপর।
আর কত স্ববিরোধিতা?
শিক্ষাক্ষেত্রে এই ঝাঁকিটার প্রয়োজন ছিল। এ ঝাঁকি যুগান্তকারী। ধন্যবাদ মাননীয়_শিক্ষামন্ত্রী এই যুগান্তকারী ঝাঁকি দেওয়ার জন্য।আমার মননে নতুন অনুরনন সৃষ্টির জন্য।
লেখক: যুগ্ম সচিব, বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন, ঢাকা