বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তত্ত্বাবধানে আয়োজন করা হবে ‘একক ভর্তি পরীক্ষা’। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই এ পদ্ধতি চালু হবে। এ লক্ষ্যে নতুন একটি অধ্যাদেশ জারি করবেন রাষ্ট্রপতি। অধ্যাদেশের খসড়া এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে ইউজিসি। মন্ত্রণালয় তা যাচাই-বাছাই করে গেজেট আকারে জারি করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
ইউজিসির তথ্য ও অধ্যাদেশের খসড়া অনুযায়ী— শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয়ভাবে একটি পরীক্ষায় অংশ নিলেই সব সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবেন। এতে ভোগান্তি, খরচ ও দীর্ঘসূত্রতা কমবে। ফলে একসঙ্গে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়াকে সাধুবাদ জানান শিক্ষাবিদ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
তবে অধ্যাদেশের খসড়ার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পরীক্ষা একসঙ্গে হলেও ফল প্রকাশের পর মেধাতালিকা প্রণয়নে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা শর্ত নির্ধারণ করার অবাধ সুযোগ পাবে। এনিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকরা সংশয় প্রকাশ করছেন। তাদের মতে, দেশে বর্তমানে ৫৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কার্যক্রম চালু রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা আলাদা অনুষদ-বিভাগে আবার ভিন্ন ভিন্ন শর্ত।
খসড়া অধ্যাদেশের ১১ নম্বর ধারায় ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। এ ধারার ২ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, ‘কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ফলাফল প্রকাশের পর সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন বিষয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে নিজস্ব শর্তাবলি অনুযায়ী এ ফলাফলকে মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণপূর্বক শিক্ষার্থীদের এর আগে সম্পাদিত এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলকে বিবেচনায় নিয়ে মেধাক্রম প্রস্তুতপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করবে।’
৩ নম্বর উপধারায় বলা আছে, ‘উপধারা ১ ও ২-এর বিধান সাপেক্ষে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় চাইলে সীমিত পর্যায়ে শুধু সঙ্গীত, চারুকলা, নৃত্যকলা, নাট্যকলা, স্থাপত্যবিদ্যা বা এজাতীয় বিশেষায়িত বিষয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড অ্যাপটিটিউট টেস্ট গ্রহণ করিতে পারবে।’ এছাড়া ৪ নম্বর উপধারায় উল্লেখ রয়েছে ‘অতি-বিশেষায়িত বিষয়সমূহ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রক্রিয়া ও প্রশ্ন প্রণয়নে কাজ করা শিক্ষকরা বলছেন, খসড়া অধ্যাদেশের ১১ ধারার ২, ৩ ও ৪ নম্বর উপধারাকে ‘হাজারো’ শর্ত তৈরির উন্মুক্ত দরজা বলে মন্তব্য করেছেন। যেগুলো একক ভর্তি পরীক্ষার সুফলের চেয়ে পরবর্তীসময়ে শিক্ষার্থীদের কাছে ‘বিষফোঁড়া’ হয়ে উঠতে পারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং একাডেমিক কাউন্সিলের একজন সদস্য নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘একক ভর্তি পরীক্ষা নিঃসন্দেহে ভালো। এটা নিয়ে সবাই আশাবাদী। ছাত্র-ছাত্রীদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দৌড়াদৌড়ির যে ভোগান্তি, তা কিছুটা কমবে। তবে বহু শর্তের ব্যাপারটা এখানে থাকবেই। এসব শর্ত রাখার সুযোগ দিয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। তাদের শিক্ষার্থী বেছে নেওয়ার অবাধ সুযোগ দেবে এ অধ্যাদেশ।’
তিনি বলেন, ‘দেখুন— বুয়েট কিন্তু বলবে ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থী যত নম্বরই পাক, এসএসসি-এইচএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাওয়া ছাড়া কাউকে মেধাতালিকায় আমরা রাখবো না। এ শর্ত দিলে এমনও হতে পারে পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীও সেখানে ভর্তির সুযোগ পাবেন না। তখন তো তিনি প্রশ্ন তুলতেই পারেন পরীক্ষায় ভালো করেও কেন আমাকে নেওয়া হলো না? যদি উচ্চ আদালতে রিট করে বসেন, তখন তো ঝুলে যাবে প্রক্রিয়াটা।’
ভর্তির আবেদনের আগেই সব শর্ত প্রকাশ করা গেলে জটিলতা কিছুটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করেন অধ্যাপক আবুল কাশেম। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ফল প্রকাশের পর শর্ত জানালে সেটা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করা হবে। অবশ্যই ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা বিভাগের শর্তগুলো প্রকাশ করতে হবে। যেহেতু নতুন নিয়ম, সেগুলো ব্যাপকভাবে প্রচারেরও উদ্যোগ নিতে হবে। নিয়ম করে নিজেদের ফাইলে বন্দি রাখা যাবে না। সেটা করা গেলে হয়তো পরীক্ষার আগেই শিক্ষার্থীরা কিছুটা মানিয়ে নিতে পারবে। তারপরও শর্তের কারণে অভিভাবক নিয়ে শিক্ষার্থীদের সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে দৌড়ঝাঁপ করতেই হবে। ভোগান্তি-খরচ থেকেই যাবে।’
জানতে চাইলে ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমনিতেই কিছু শর্ত থাকে। এখন এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় একসঙ্গে পরীক্ষা নেবে, ফল প্রকাশ এবং মেধাতালিকা তৈরি করবে। সেক্ষেত্রে কিছু ভিন্ন ভিন্ন শর্ত থাকবে। সেগুলো শিক্ষার্থীরা যাতে আগেই জানতে পারেন, সে ব্যাপারে আলোচনা করে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয় শাখা) আবু ইউসুফ মিয়া বলেন, ‘ইউজিসির পাঠানো খসড়া অধ্যাদেশ পর্যালোচনা করছি আমরা। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বৈঠক হবে। সেখানে কিছু যুক্ত হতে পারে, বাদও পড়তে পারে। এরপর যেটি চূড়ান্ত হবে, সেটি আমরা রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে পাঠাবো। সেখান থেকে অধ্যাদেশ জারির নির্দেশনা আসবে।’
১০ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে নিয়ে কমিটি
খসড়া অধ্যাদেশ অনুযায়ী ‘একক ভর্তি পরীক্ষা’ পরিচালনায় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ১৩ সদস্যের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি করা হবে। সেখানে চেয়ারম্যান হিসেবে থাকবেন ইউজিসি চেয়ারম্যান। ইউজিসি থেকে আরও দুজনকে সদস্য হিসেবে কমিটিতে মনোনয়ন দেবেন তিনি। বাকি ১০ সদস্য পদে থাকবেন দেশের ১০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।
এর মধ্যে ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত। সেগুলো হলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। বাকি চারটি ‘উপাচার্য-সদস্য’ পদে মনোনয়ন দেবেন ইউজিসি চেয়ারম্যান।
কমিটিতে বুয়েট ছাড়া কোনো প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও থাকছেন না। এটা বেমানান এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির ক্ষেত্রে সমস্যা হিসেবে দেখছেন একটি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয় ও নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘চারটি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি গুচ্ছ ভর্তি কার্যক্রম চলছিল। এবারও আমরা সেটা করলাম। অথচ একক ভর্তি পরীক্ষার মূল কমিটিতে কোনো প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে রাখা হয়নি। যে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে ইউজিসি চেয়ারম্যান মনোনয়ন দেবেন, তারা কারা সেটাও মোটামুটি সবাই নিশ্চিত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থাকবেই। বাকি একটি সদস্য পদে প্রকৌশল-প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে রাখার দাবি জানাবো আমরা।’