নতুন শিক্ষাক্রম চালুর শুরুতে বলা হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা আনন্দের সঙ্গে শিখবে, পরীক্ষাভীতি থাকবে না। নেই কোনো পাস-ফেল। এভাবে চললে কোচিং ব্যবসা ও নোট-গাইড বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু বছরের শেষ দিকে যখন চূড়ান্ত মূল্যায়ন নির্দেশিকা প্রকাশ হলো তখন দেখা গেল পাস-ফেল রয়েই গেছে।
সূত্র জানায়, নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের দায়িত্ব জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি)। মাঠপর্যায়ে তা কার্যকর করার দায়িত্ব মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের। শিক্ষা বোর্ডগুলোরও এ ব্যাপারে দায়িত্ব রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে শিক্ষাক্রম প্রণয়নের পাশাপাশি মূল্যায়ন পদ্ধতি নির্ধারণেও মাউশি অধিদপ্তরের বড় ভূমিকা থাকার কথা। কারণ মাঠপর্যায়ের চিত্র তারাই ভালো জানে। কিন্তু মাউশি অধিদপ্তরকে পাশে ঠেলে এনসিটিবি একক সিদ্ধান্তে সব করছে বলে অভিযোগ।
জানতে চাইলে এনসিটিবি’র সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘আমরা মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা করেছি, বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিক বৈঠক করেছি। ষাণ¥াষিক পরীক্ষায় নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতিতে আমরা ভালো ফল পেয়েছি। তাই সর্বশেষ যেটা প্রকাশ করা হয়েছে এখন পর্যন্ত সেটাই ফাইনাল। তবে ত্রুটি ধরা পড়লে কাঠামো ঠিক রেখে সংশোধন করা হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে সারা বছরই মূল্যায়ন হবে; একজন শিক্ষার্থীর প্রতিযোগিতা হবে নিজের সঙ্গে। কোথায় তার গ্যাপ, কোথায় আরও ভালো করতে হবে সে প্রতিযোগিতা।’
মূল্যায়ন নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, একজন শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করে ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভুজ চিহ্ন দেবেন শিক্ষকরা। ত্রিভুজ হচ্ছে সবচেয়ে দক্ষ বা ভালো, বৃত্ত হচ্ছে মোটামুটি ভালো এবং চতুর্ভুজ মানে উন্নতি প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে হলে স্কুলে তাদের উপস্থিতির হার ও বিষয়ভিত্তিক পারদর্শিতা বিবেচ্য হবে। ৭০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিত থাকলে তাকে নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা যাবে। তিনটি বিষয়ের ট্রান্সক্রিপ্টে কোনো শিক্ষার্থীর অর্জনের মাত্রা যদি ‘চতুর্ভুজ’ হয় তাহলে তাকে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তরণের জন্য বিবেচনা করা যাবে না। আর পারদর্শিতার বিবেচনায় কোনো উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর ক্লাসে উপস্থিতি কম হলে পরের ক্লাসে তাকে উঠতে দেওয়া হবে কি না তার সিদ্ধান্ত নেবেন শিক্ষকরা।
নাম প্রকাশ না করে একজন অভিভাবক বলেন, ‘এতদিন আমরা জিপিএ ৫-এর পেছনে দৌড়াতাম, এখন ‘ত্রিভুজ’-এর পেছনে দৌড়াতে হবে। তাহলে জিপিএ বাদ দেওয়ার কী দরকার ছিল? এখন যদি শিক্ষকরা একজন শিক্ষার্থীকে ত্রিভুজ দেন তাহলে তাকে জিপিএ ৫ দিলেই তো হতো। প্রয়োজনে গ্রেডিং কমিয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জিপিএ ৫-এর বদলে জিপিএ ৪ করা যেত। বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদেরও সুবিধা হতো।’
তিনি বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমে লিখিত পরীক্ষা নেই বললেই চলে। শিক্ষার্থীরা একক বা দলগত কাজ করবে। আর মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকরা। শিক্ষকরা যদি দলগত কাজের জন্য দলের সব শিক্ষার্থীকে চতুর্ভুজ দিয়ে দেন তাহলে কিছু করার থাকবে না। দলগত কাজ একজন শিক্ষার্থীর ওপর নির্ভর করে না। আগে যে অভিভাবক দুজন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়াতেন, এখন তিনি পাঁচ-ছয়জনের কাছে প্রাইভেট পড়ান। শিক্ষক প্রাইভেটে কী পড়ালেন সেটা বিষয় নয়, শিক্ষার্থী যে প্রাইভেট পড়ে সেটাই বড় বিষয়।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘আমাদের দেশে ঢাকঢোল পিটিয়ে ১৪ বছর আগে চালু হয়েছিল সৃজনশীল পদ্ধতি। সেটা সফল না হলেও আবারও নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। তাই নতুন শিক্ষাক্রম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ধাপে ধাপে কার্যকর করা উচিত ছিল। মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়েও বিশদ আলোচনার দরকার ছিল। এখনো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বড় কোনো পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। তারা তড়িঘড়ি করে সব চালু করতে চায়।’
জানা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকরা নতুন শিক্ষাক্রমে এখনো অভ্যস্ত হতে পারেননি। প্রশিক্ষণ পেলেও অনেকেই তা বুঝে উঠতে পারেননি। একটি শ্রেণিতে শিক্ষার্থীসংখ্যা বেশি হলে সবাইকে বোঝানো একজন শিক্ষকের পক্ষে কষ্টকর। অনেক স্কুলেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, ল্যাবরেটরি ও উপকরণ নেই। শিক্ষকরা কতটা নির্মোহভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করবেন তা নিয়েও অভিভাবকরা সন্দিহান।
শিক্ষা ও শিশুরক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক রাখাল রাহা গত শুক্রবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘নতুন কারিকুলামে হাতেকলমে শিখে তারপর তত্ত্বে আসার যে শিক্ষা, এটা কোনো সাধারণ ধারা নয়। এ কারিকুলাম জাতির সঙ্গে রাষ্ট্রের, সরকারের এবং মন্ত্রণালয়ের প্রতারণা। কারিকুলাম নিয়ে এক ধরনের খেলা খেলছে। শিক্ষার মান কমে যাওয়া নিয়ে সারা দেশেই প্রশ্ন। মানোন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষিত শিক্ষক প্রয়োজন; ক্লাসরুমের মান উন্নয়ন এবং শিক্ষকদের বেতনবৃদ্ধি দরকার। অথচ সরকার তার থেকে অনেক দূরে।’
প্রসঙ্গত, এ বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। আগামী বছর দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে এ শিক্ষাক্রম চালু হবে। ২০২৫ সালে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি এবং এবং দশম শ্রেণি যুক্ত হবে। ২০২৬ সালে একাদশ ও ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণি যুক্ত হবে।