বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ : নভেম্বর ১১, ২০২৫
অনলাইন সংস্করণ

মেডিকেল কলেজে আসন পুনর্বিন্যাস: মানোন্নয়নের যুক্তি নাকি চিকিৎসক সংকটের আশঙ্কা

দেশের সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আসন সংখ্যা পুনর্বিন্যাস করেছে সরকার। ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষে মোট ৭২২টি আসন কমানো হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি মেডিকেলে কমেছে ৩৫৫টি আসন, তবে তিনটি কলেজে ৭৫টি আসন বাড়ানোয় নিট হিসেবে সরকারি কলেজে আসন কমেছে ২৮০টি।

স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের চিকিৎসা শিক্ষা-১ শাখা থেকে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে পাঠানো এক চিঠিতে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়। পরে অধিদপ্তর নতুন শিক্ষাবর্ষের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।

🔹 প্রথম সারির ১০ মেডিকেলে আসন কমানো

বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, দেশের প্রথম সারির ৯টি পুরনো মেডিকেল কলেজ—ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সিলেট এমএজি ওসমানী, বরিশালের শের-ই-বাংলা, ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ, রংপুর এবং কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ—প্রত্যেকটির ২৫টি করে আসন কমিয়ে ২৫০ থেকে ২২৫ করা হয়েছে।
এছাড়া শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজেও ৫টি কমিয়ে আসন নির্ধারণ করা হয়েছে ২২৫টি। ফলে প্রথম সারির এই ১০টি মেডিকেল কলেজে মোট ২৩০টি আসন কমেছে।

🔹 পিছিয়ে থাকা মেডিকেলে বড় কাটছাঁট

রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে মান নিয়ে আলোচিত হবিগঞ্জ মেডিকেল কলেজ থেকে ৫০টি আসন কমিয়ে ৫০ নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া নেত্রকোনা, নীলফামারি, নওগাঁ, মাগুরা ও চাঁদপুর মেডিকেল কলেজে ২৫টি করে কমিয়ে আসন নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০টি করে।

🔹 তিন মেডিকেলে আসন বেড়েছে

গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ এবং পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজে আসন বৃদ্ধি পেয়েছে। তাজউদ্দীন ও টাঙ্গাইলে ২৫টি করে বাড়িয়ে আসন হয়েছে ১২৫টি এবং পটুয়াখালী মেডিকেলে ২৫টি বাড়িয়ে ১০০ নির্ধারণ করা হয়েছে।

🔹 অধিদপ্তরের যুক্তি: মানোন্নয়ন ও অবকাঠামো সীমাবদ্ধতা

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. রুবীনা ইয়াসমিন বলেন,“এটি আসন কমানো নয়, বরং সমন্বয়। ২০২২ সালে হঠাৎ করে ১০৩০টি আসন বাড়ানো হয়েছিল, কিন্তু অবকাঠামো বাড়ানো হয়নি। অনেক জায়গায় লেকচার গ্যালারির ধারণক্ষমতা ২৫০ হলেও শিক্ষার্থী নেওয়া হয়েছিল ২৫০ বা তারও বেশি। তাই আসন সংখ্যা বাস্তবসম্মতভাবে সমন্বয় করা হয়েছে, যেন শিক্ষার্থীরা আরামদায়ক পরিবেশে পড়াশোনা করতে পারে।”

তিনি আরও বলেন,“হ্যাঁ, কেউ বলতে পারে সুযোগ কমছে, কিন্তু মানের চিকিৎসক তৈরি করতে গেলে মানদণ্ড বজায় রাখতে হবে। যত্রতত্র ভর্তি নিলে ভালো ডাক্তার তৈরি হবে না।”

🔹 বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি: মানোন্নয়ন হোক, তবে যুক্তিসঙ্গতভাবে

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সদস্য ও বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সৈয়দ আকরাম হোসেন বিষয়টিকে “যুক্তিসঙ্গত সমন্বয়ের” প্রয়োজনীয়তা হিসেবে দেখছেন।
তিনি বলেন,“বাংলাদেশে এখনো জনগোষ্ঠীর তুলনায় চিকিৎসক ঘাটতি রয়েছে। তাই আসন কমানোর সিদ্ধান্তের পেছনে শক্ত যুক্তি ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড থাকতে হবে। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেডিকেল এডুকেশনের (ডব্লিউএফএমই) মানদণ্ডে প্রতিটি মেডিকেল কলেজের মূল্যায়ন করা উচিত। তারপর যেখানে ঘাটতি, সেখানে সমাধানমূলক পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।”

অধ্যাপক আকরাম আরও বলেন,রাষ্ট্রের উচিত চিকিৎসক তৈরির প্রক্রিয়াকে শুধু সংখ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে মান ও চাহিদার ভারসাম্য বিবেচনা করা। সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেই ঘাটতি রয়েছে, বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ক্ষেত্রে। তাই যে মেডিকেল কলেজ ভালো পারফর্ম করছে, সেটি সরকারি হোক বা বেসরকারি—রাষ্ট্রের উচিত তাদের প্রণোদনা ও সহায়তা দেওয়া।”

তার মতে,“আসন কমানো যুক্তিযুক্ত হতে পারে, কিন্তু সেটি যদি প্রক্রিয়াগতভাবে—যেমন ডব্লিউএফএমই মানদণ্ডে যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে—করা হয়, তবেই তা গ্রহণযোগ্য ও যৌক্তিক হয়।”

মন্তব্য করুন
×