২০২৫ সালের উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৮.৮৩ শতাংশ। এই ফল গত ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ফলস্বরূপ, মোট ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৬১ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৫ লাখ ৮ হাজার ৭০১ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে। এই ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষার্থীর ফেল করা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা, পরীক্ষা মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং কোভিড-পরবর্তী শিখন-ঘাটতির গভীর বাস্তবতাকে উন্মোচন করেছে। শিক্ষা উপদেষ্টা এটিকে 'অস্বস্তিকর হলেও বাস্তবভিত্তিক' আখ্যা দিয়ে দীর্ঘদিনের 'শেখায় সংকট' ও 'ন্যায্য মূল্যায়নের' ওপর জোর দিয়েছেন।
১. অকৃতকার্যতার পরিসংখ্যানগত চিত্র
২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা শুধু একটি সংখ্যা নয়, এটি একটি alarm bell:
|
সূচক
|
সংখ্যা / হার
|
|
মোট পরীক্ষার্থী
|
১২,৩৫,৬৬১ জন
|
|
মোট উত্তীর্ণ
|
৭,২৬,৯৬০ জন
|
|
মোট অকৃতকার্য
|
৫,০৮,৭০১ জন
|
|
পাসের হার
|
৫৮.৮৩%
|
|
অকৃতকার্যের হার
|
প্রায় ৪১.১৭%
|
|
জিপিএ-৫ প্রাপ্তি
|
৬৯,০৯৭ জন
|
- বিশাল ব্যবধান: গত বছরের তুলনায় পাসের হার কমেছে প্রায় ১৮.৯৫ শতাংশ পয়েন্ট। এর অর্থ, ২০২৪ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ পরীক্ষার্থী এবার ফেল করেছে।
- জিপিএ-৫ এ ধস: জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যাও কমেছে ৭৬ হাজার ৮১৪ জন, যা নির্দেশ করে শুধু পাসের হার নয়, মানসম্মত ফলাফল অর্জনের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের পতন ঘটেছে।
২. ফল বিপর্যয়ের মূল কারণসমূহ: শিক্ষা উপদেষ্টার দৃষ্টিতে
অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার এই ফলাফলকে 'বাস্তবতার প্রতিফলন' হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর অকৃতকার্য হওয়ার পেছনে নিম্নলিখিত কারণগুলো সরাসরি দায়ী:
ক. 'ন্যায্য মূল্যায়নে' ফিরে আসা
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়নে 'নম্বর বাড়িয়ে দেখানোর' একটি প্রবণতা ছিল। শিক্ষা উপদেষ্টা এইবার সেই 'অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে সন্তুষ্টি'র সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে **'ন্যায্য নম্বর দিয়ে সততা'**কে বেছে নেওয়ার নির্দেশ দেন। এর ফলে:
- গ্রেস মার্কস বন্ধ: ধারণা করা হচ্ছে, পাস নম্বর (৩৩) থেকে সামান্য কম পাওয়া শিক্ষার্থীদের যে গ্রেস মার্কস দিয়ে পাস করিয়ে দেওয়ার অলিখিত প্রবণতা ছিল, এবার তা কঠোরভাবে বন্ধ করা হয়েছে।
- পরীক্ষকের কঠোরতা: খাতা দেখার ক্ষেত্রে পরীক্ষকদের বোর্ড কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশিকা কঠোরভাবে অনুসরণ করতে বলা হয়, যার ফলে সামান্য ঘাটতি বা ত্রুটির কারণেও শিক্ষার্থীরা অনুত্তীর্ণ হয়েছে।
খ. দীর্ঘদিনের 'শেখার সংকট'
শিক্ষা উপদেষ্টার মতে, এই ফল বিপর্যয় রাতারাতি তৈরি হয়নি। এটি প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু হওয়া 'শেখার ঘাটতি'-র চূড়ান্ত প্রতিফলন। শিক্ষার্থীরা বছরের পর বছর ধরে যথাযথ ভিত্তিমূলক শিক্ষা না পেয়ে উচ্চশিক্ষা স্তরে আসায়, পূর্ণাঙ্গ সিলেবাস ও স্বাভাবিক মূল্যায়নের মুখোমুখি হয়ে তারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
গ. কোভিড-পরবর্তী 'স্বাভাবিক' পরীক্ষা পদ্ধতি
২০২৫ সালের পরীক্ষার্থীরাই প্রথম ব্যাচ, যারা কোভিড-১৯ মহামারীর অস্বাভাবিকতা কাটিয়ে পূর্ণ নম্বর, পূর্ণ সময় এবং সম্পূর্ণ সিলেবাসে পরীক্ষা দিয়েছে।
- ২০২০ (অটোপাস): এই পরীক্ষার্থীরা যখন দশম শ্রেণিতে ছিল, তখন তারা অটোপাস পেয়েছিল।
- ২০২১-২০২২ (সংক্ষিপ্ত সিলেবাস): একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতেও তারা পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ শিক্ষা ও পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে পড়ার সুযোগ পায়নি।
- শিখন-ঘাটতি: স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত থাকার কারণে তাদের শিখন-ঘাটতি (Learning Gap) ছিল বিশাল, যা পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষায় স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে।
ঘ. বিষয়ভিত্তিক দুর্বলতা
ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবিরের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, অকৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ ইংরেজি, গণিত এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (ICT)-এর মতো মৌলিক বিষয়গুলোতে দুর্বল ছিল। এ সকল বিষয়ে ফেল করার কারণে সামগ্রিক পাসের হার হ্রাস পেয়েছে।
৩. বোর্ডভিত্তিক তারতম্য ও শিক্ষার বৈষম্য
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিভিন্ন বোর্ডের পাসের হারেও বিশাল তারতম্য রয়েছে:
- ঢাকা বোর্ড: ৬৪.৬২% (অন্যান্য বোর্ডের তুলনায় এগিয়ে)
- কুমিল্লা বোর্ড: ৪৮.৮৬% (সবচেয়ে কম পাসের হার)
- মাদরাসা বোর্ড: ৭৫.৬১% (সাধারণ বোর্ডগুলোর তুলনায় এগিয়ে)
কুমিল্লা বোর্ড ও যশোর বোর্ডের মতো অনেক অঞ্চলে পাসের হার ৫০ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। এই তারতম্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মান, শিক্ষকের সক্ষমতা, গ্রামীণ ও শহর অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের সুযোগের বৈষম্য এবং বোর্ডের প্রশ্ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতির ভিন্নতার দিকে ইঙ্গিত করে।